ফারসি ভাষা থেকে আসা ‘আইন’ শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো Law, যার আভিধানিক অর্থ হলো স্থির ও অপরিবর্তনীয়। আইনের কোনো নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। বিভিন্ন দার্শনিক ও আইনবিদ নানা দৃষ্টিকোণ থেকে আইনকে সংজ্ঞায়িত করেছেন, কিন্তু আইনের সংজ্ঞা সময়ের সঙ্গে পরিবর্তনশীল। আইন বলতে সাধারণভাবে সমাজ স্বীকৃত এবং রাষ্ট্র কর্তৃক অনুমোদিত নিয়মকানুনকে বোঝায়, যা মানুষের বাহ্যিক আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে। অ্যারিস্টটল বলেছেন, ‘সমাজের যুক্তিসিদ্ধ ইচ্ছার অভিব্যক্তিই হচ্ছে আইন।’ আইনবিদ জন অস্টিনের মতে, ‘সার্বভৌম শক্তির আদেশই আইন।’ যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন বলেন, ‘আইন হলো সমাজের সেসব সুপ্রতিষ্ঠিত প্রথা ও রীতিনীতি, যেগুলো সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত ও রাষ্ট্র কর্তৃক গৃহীত বিধিতে পরিণত হয়েছে এবং যাদের পেছনে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের সুস্পষ্ট সমর্থন রয়েছে।’
বাংলাদেশ সংবিধানের ১৫২ নম্বর অনুচ্ছেদে আইনের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। ওই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, আইন অর্থ কোনো আইন, অধ্যাদেশ, বিধি, প্রবিধান, উপআইন, বিজ্ঞপ্তি ও অন্যান্য আইনগত দলিল এবং বাংলাদেশে আইনের ক্ষমতাসম্পন্ন যেকোনো প্রথা বা রীতি।
আইন ও নৈতিক বিধির সম্পর্ক ও পার্থক্য
আইন ও নৈতিক বিধির মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। আইন ও নৈতিক বিধি উভয়ের বিষয়বস্তু মানুষ এবং উদ্দেশ্য মানুষের কল্যাণসাধন। জনগণের সম্মতি ছাড়া আইন কার্যকর করা দুরূহ। নৈতিকতা বিরুদ্ধ আইন অনেক ক্ষেত্রে জনসম্মতি হারায় বরং জনরোষ সৃষ্টি করতে পারে। আবার নৈতিক বিধি মানুষের আইনগত অধিকার লঙ্ঘনের কারণ হলে রাষ্ট্র সে ক্ষেত্রে আইনের সাহায্যে হস্তক্ষেপ করতে পারে। আইন ও নৈতিক বিধির মধ্যে সম্পর্ক ও নির্ভরশীলতা থাকা সত্ত্বেও দুটোর মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। আইন মানবসমাজের দর্পণস্বরূপ। মানুষের দেহ, সম্পত্তি, সুনাম ও মর্যাদা সুরক্ষার উদ্দেশ্যে আইন প্রণীত হয়ে থাকে, যা মেনে চলা রাষ্ট্রের নাগরিকদের জন্য বাধ্যতামূলক। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি, অনুমোদন এবং আইন মেনে চলার বাধ্যবাধকতা আইনের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য, যার উপস্থিতি ছাড়া কোনো বিধিনিষেধ আইনে পরিণত হয় না। নৈতিক বিধি হলো ধর্ম বা সমাজ আরোপিত বিভিন্ন বিধিনিষেধ, যা মানুষের বিবেকবোধ, নীতিবোধ, ভালো-মন্দ, উচিত-অনুচিতের ধারণার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। আইন মানুষের বাহ্যিক আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে, কিন্তু নৈতিক বিধি মানুষের চিন্তা ও মনোভাব নিয়ে যে অন্তর্জগৎ, সেটির নিয়ন্ত্রণকে গুরুত্ব দেয়।
আইনের বিধানগুলো সাধারণত লিখিত ও সুনির্দিষ্ট হয়ে থাকে, অন্যদিকে নৈতিক বিধি আইনের মতো লিখিত ও বিধিবদ্ধরূপে থাকে না। ফলে নৈতিক বিধির প্রয়োগ আইনের মতো স্পষ্ট ও কাঠামোবদ্ধ নয়। রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গ ও প্রতিষ্ঠান আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করে থাকে। আইন ভঙ্গ করলে রাষ্ট্র বা সার্বভৌম কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনে বলপ্রয়োগ ও শাস্তি বিধানের মাধ্যমে আইন মেনে চলতে বাধ্য করতে পারে, কিন্তু নৈতিক বিধি কার্যকর করার বিষয়টি মানুষের নিজস্ব বিবেচনা ওবিবেকবোধের ওপর নির্ভরশীল। সর্বজনীনতা আইনের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। অর্থাৎ সব মানুষ আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং রাষ্ট্রের সবার ওপর আইন সমভাবে প্রযোজ্য, অন্যদিকে নৈতিক বিধি অঞ্চল ও ব্যক্তিভেদে আলাদা হতে পারে। আইন বিরুদ্ধ হলেও কোনো বিষয় নৈতিকতা বিরুদ্ধ না-ও হতে পারে, তেমনি নৈতিকতা বিরুদ্ধ হলেও অনেক বিষয় আবার বেআইনি নয়। আইনের অন্যতম একটি সুবিধা হচ্ছে এটি ব্যক্তিগত ইচ্ছাপ্রসূত স্বেচ্ছাচারিতা ও পক্ষপাত প্রতিরোধ করে। অন্যদিকে আইনের অসুবিধা ও সীমাবদ্ধতা হচ্ছে এটির অনমনীয়তা, আনুষ্ঠানিকতা, জটিলতা ও রক্ষণশীলতা।আইন কত প্রকার?
প্রাথমিকভাবে আইন দুই প্রকার, যথা দেশীয় আইন এবং আন্তর্জাতিক আইন। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ কর্মকাণ্ড পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের জন্য নানা ধরনের আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগের প্রয়োজন পড়ে, যা সাধারণত সেই দেশের আইনসভা বা পার্লামেন্ট কর্তৃক প্রণীত হয়ে থাকে। এগুলোকে দেশীয় আইন বলা হয়। দেশীয় আইনকে আবার দুই ভাগ করা যায়, যথা সর্বজনীন আইন ও ব্যক্তিগত বা পারিবারিক আইন। যে আইন রাষ্ট্রের প্রকৃতি, গঠন, ক্ষমতা ও কার্যাবলি, সরকারের বিভিন্ন বিভাগের প্রশাসনিক দায়দায়িত্ব বণ্টন এবং রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিকের সম্পর্ক নির্ধারণ করে তাকে সর্বজনীন আইন বা পাবলিক ল বলা হয়। সাংবিধানিক আইন, প্রশাসনিক আইন, ফৌজদারি আইন প্রভৃতি সর্বজনীন আইনের উদাহরণ। সংবিধান রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন। সাংবিধানিক আইনের মাধ্যমে অন্যান্য আইন বৈধতা পেয়ে থাকে। অন্য যেকোনো আইন সাংবিধানিক আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলে সেটি বাতিল বলে গণ্য হয়। সাংবিধানিক আইনের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সীমা নির্ধারণ, রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গের মধ্যে ক্ষমতার বণ্টন ও ক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিত করা হয়।
এ ছাড়া সাংবিধানিক আইন রাষ্ট্রের জনগণের অধিকারের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে। সর্বজনীন আইনের যে শাখা সরকারি বিভিন্ন সংস্থার প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড ও অভ্যন্তরীণ নিয়ম-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করে, তাকে প্রশাসনিক আইন বলে। ফৌজদারি আইনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে রাষ্ট্রের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা, নাগরিকের প্রতি সংঘটিত অপরাধের বিচার ও দণ্ডবিধান করা, যেমন হত্যা, সন্ত্রাস, নারী ও শিশু নির্যাতন, যৌতুক দাবির মতো অপরাধের বিচার করা।অন্যদিকে ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির আইনগত সম্পর্ক, পারস্পরিক অধিকার ও কর্তব্য যে আইনে নির্ধারণ করা হয়, সেটি ব্যক্তিগত বা পারিবারিক আইন। এই আইন সাধারণত দেওয়ানি প্রকৃতির হয়ে থাকে।
দেওয়ানি প্রকৃতির আইনের লক্ষ্য হচ্ছে কোনো বিষয়ের ওপর ব্যক্তির অধিকার প্রতিষ্ঠা কিংবা আইনগত দাবির স্বীকৃতি ও অধিকার ভঙ্গের প্রতিকার বিধান করা। যেমন ভূমি ও সম্পত্তির আইনগত স্বত্ব ও দখল ঘোষণা, পদের অধিকার দাবি, উত্তরাধিকার, ভরণপোষণ, দেনমোহর, বিবাহবিচ্ছেদ, সন্তানের অভিভাবকত্ব দাবি কিংবা চুক্তিসংক্রান্ত আইন দেওয়ানি প্রকৃতির ব্যক্তিগত বা পারিবারিক আইনের উদাহরণ। এ ধরনের আইনের বিধান বাংলাদেশে প্রধানত ধর্ম থেকে উদ্ভূত হলেও সংসদ প্রণীত ধর্মনিরপেক্ষ প্রকৃতির অথবা ধর্ম ও রাষ্ট্রীয় আইনের সংমিশ্রণেও তৈরি হতে পারে। বর্তমান বিশ্বে কোনো রাষ্ট্রই স্বয়ংসম্পূর্ণ বা আত্মনির্ভরশীল নয়। প্রতিটি রাষ্ট্রই অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিকসহ বহুবিধ পারস্পরিক সম্পর্ক ও সহযোগিতার বন্ধনে আবদ্ধ হয়। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শান্তি ও শৃঙ্খলার স্বার্থে রাষ্ট্রসমূহের পারস্পরিক সম্পর্ক সুষ্ঠুভাবে নিয়ন্ত্রিত হওয়ার প্রয়োজনের তাগিদেই আন্তর্জাতিক আইনের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে।